পঞ্চগড় প্রতিনিধি
দেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম দর্জিপাড়ায় এবারও ফুটেছে ভিনদেশী বাহারী ফুল ‘টিউলিপ’। সারিবদ্ধ বাগানে ফুটেছে বাহারি এ ফুল। স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে গত বছর স্থানীয় ৮ জন কৃষকের ৪০ শতাংশ জমিতে পরীক্ষামুলক এই ফুল চাষ করা হয়। গত বছরের সাফল্য দেখে এ বছর ২০ জন নারী উদ্দ্যোক্তা তাদের ১০ শতক করে ২০০ শতক (২ একর) আবাদী জমিতে চাষ করা হয়েছে টিউলিপ। এবার দেড় থেকে দুই কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন কৃষক সহ সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় উদ্যোক্তা চাষী ও ইএসডিও সূত্র জানায়, ভিনদেশী এবং বাহারী ফুল টিউলিপ। এই ফুল সাধারণত নেদারল্যান্ড, কাশ্মীর, তুরস্কের মতো শীত প্রধান দেশে চাষ হয়। তবে শীতপ্রবণ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহযোগিতায় বেসরকারি সংস্থা ইকো সোস্যাল ডেভলেভমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) টিউলিপ চাষ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। এই ফুল চাষ হিমালয় কন্যা খ্যাত তেঁতুলিয়ার সম্ভাবনাময় পর্যটনে নতুন সংযোগ বলে মনে করছেন স্থানীয় ফুলপ্রেমীরা। এখানকার আবহাওয়া ও মাটি টিউলিপ চাষের উপযোগী হওয়ায় বাগানের প্রতিটি ফুল ফুটেছে।
গত বছর ৬ প্রজাতির ১২ রংয়ের টিউলিপ চাষ করা হলেও এবারের টিউলিপ চাষ প্রকল্পে বাণ্যিজিকভাবে ১০ প্রজাতির ফুলের ১ লাখ ফুলের বাল্ব বা বীজ রোপন করা হয়েছে।
টিউলিপের প্রজাতিগুলো হলো অ্যান্টার্কটিকা হোয়াইট (সাদা), ডেনমার্ক (কমলা ছায়া), লালিবেলা (লাল), ডাচ সানরাইজ (হলুদ), ষ্টংগোল্ড (হলুদ), জান্টুপিঙ্ক (গোলাপী), হোয়াইট মাভেল (সাদা), মিষ্টিকভ্যান ইজক (গোলাপী), হ্যাপী জেনারেশন (সাদা লাল ছায়া), এবং গোল্ডেন টিকিট (হলুদ)।
এবার চারার দাম, শেড নেট, ফেন্সিং নেট (বেড়ার জাল), রাসায়নিক সার, জৈব সার, কীটনাশক ও মুজুরী বাবদ এ পর্যন্ত মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৮০ লাখ টাকা। ইতি মধ্যে টিউলিপ বাগান থেকে ঢাকায় প্রায় দুই লাখ টাকার ফুল বিক্রির জন্য পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া গত মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারী) থেকে স্থানীয় ভাবেও ফুল ও চারা বিক্রি শুরু করা হয়। প্রতিটি ফুল স্টিকসহ রংভেদে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা এবং ফুলের প্রতিটি চারা রংভেদে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। সেই সাথে রংপুর ঢাকা সহ বাইরের ফুল ব্যবসায়ীদের সাথে ফুল বিক্রির জন্য যোগাযোগ করছে সংশ্লিষ্টরা। এবার টিউলিপ চাষ করে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন স্থানীয় চাষীরা। গত বছর ৩২ লাখ টাকা খরচে ৪০ হাজার টিউলিপ ফুল ১০০ টাকা হারে বিক্রি করে মাত্র দুই মাসে ৮ লাখ টাকা আয় করেন চাষীরা। প্রতিদিনই পর্যটকেরা টিউলিপ ফুল দেখতে ভিড় করছেন সীমান্তবর্তী গ্রাম দর্জিপাড়ায়। বানিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে তোলা টিউলিপ বাগান থেকে অনেকে ফুল কিনছেন। কেউ আবার চারাসহ ফুলের টব কিনছেন।
স্থানীয় নারী উদ্যোক্তা মনোয়ারা বেগম বলেন, ইএসডিও’র সহযোগিতায় আমি গত বছর ৫ শতক জমিতে ফুল চাষ করেছিলাম। প্রতিটি ফুল ১০০ টাকা করে বিক্রি করেছিলাম। অন্য ফসলের তুলনায় অল্প সময়ে এই ফুল চাষ করে লাভবান হয়েছিলাম। তাই এবার ১০ শতক জমিতে টিউলিপ ফুল করেছি। এই ফুল দেখতে অনেকেই আসছেন, ফুল কিনছেন। আশা করি এবারও অনেক টাকা পাবো।
পাশর্^বর্তী জেলা ঠাকুরগাঁও থেকে টিউলিপ ফুল দেখতে এসেছেন নুর হাসান (৩৫)। তিনি বলেন, গত বছর পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, স্যোশাল মিডিয়ায় টিউলিট ফুল দেখেছি আসতে পারিনি। এবার স্ত্রী সন্তান নিয়ে টিউলিপ ফুল দেখতে এসেছি। সবাইকে নিয়ে ছবি তুলেছি, ভিডিও করেছি। ফুলের এমন সৌন্দর্য আমি কোনদিন দেখিনি। এখানে এসে খুব ভালো লাগলো আমাদের। মন জুড়িয়ে গেল।
তেঁতুলিয়ায় টিউলিপ ফুলচাষ প্রকল্পের সমন্বয়কারি আইনুল হক বলেন, গত বছর এই টিউলিপ ফুল বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। দেশ বিদেশের অনেক পর্যটক ফুল দেখতে এসেছিলেন। এবার একটু বড় পরিসরে বানিজ্যিকভাবে ২০ জন প্রান্তিক কৃষকের ১০ শতক করে দুই একর জমিতে ১০ প্রজাতির টিউলিপ ফুলের চারা রোপন করা হয়েছে। এই ফুলের বীজ নেদারল্যান্ড থেকে আনা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এবার দুই কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করা হচ্ছে। আশা করছি এবার দেড় থেকে দুই কোটি টাকার ফুল ও চারা বিক্রি হবে। এছাড়া লাল, সাদা, হলুদ, কমলা রংসহ ভিন্ন ভিন্ন রং এর টিউলিপ ফুল দেখে পর্যটকরা। অর্থনৈতিক লাভবানের পাশাপাশি সম্ভাবনাময় তেঁতুলিয়ার পর্যটনেও নতুন মাত্রা যোগ করেছে টিউলিপ ফুল।
ইকো সোস্যাল ডেভলেভমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) এর পরিচালক (প্রশাসন) ড. সেলিমা আখতার বলেন, সাধারণ ফসলে আমরা যে খাদ্য উৎপাদন করি, সেই ক্ষেতেই আমরা টিউলিপ ফুল চাষ করছি। এটা অল্প মেয়াদী চাষযোগ্য একটি কৃষিপন্য জাতীয় ফুল। এই ফুলের চারা রোপনের ১৮ দিনের মধ্যে কলি বের হয় এবং ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে ফুল ফুটে। তাই সেই জমিতে কিন্তু কৃষকরা অন্য কৃষিপন্যও সঠিক সময়ে উৎপাদন করে থাকেন। একজন মানুষের খাদ্য চাহিদার পাশাপাশি মনের খোড়াকও দরকার। ফুল একটি মনের খোড়াক বলে আমরা মনে করি। এছাড়া দেশে ফুলের বাজারও প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই ফুল বাজারজাত করে কৃষকরা অতি দ্রুত লাভবান হচ্ছেন।।
তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বড় পরিসরে টিউলিপ চাষ উত্তরবঙ্গের তেঁতুলিয়ায় প্রথম। এজন্য এবার বড় পরিসরে ফুল চাষ করা হয়েছে। সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর নিচে থাকা আবহাওয়া এই ফুল চাষের উপযোগি। সেক্ষেত্রে উত্তরের এই উপজেলায় ধীর্ঘ সময় শীত থাকে। এরকম শীতপ্রবণ এলাকায় টিউলিপ ফুল চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। খোরপোশ কৃষি থেকে বাণ্যিজিক কৃষিতে আমাদের ঝুঁকতে হবে।
You cannot copy content of this page