করতোয়ার তীর ঘেঁষা ছোট্ট শহর পঞ্চগড়। শহরের একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে বাজার। গড়ে উঠেছে ছোট বড় মার্কেট। বাজারের কদম তলা সবার কাছে একটি পরিচিত নাম। বিশেষ করে সাহিত্যপ্রেমিদের কাছে এই স্থানটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কদম তলায় নিউ সিটি অপসেট প্রেস চালু হওয়ার পর থেকেই সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মীদের আড্ডার প্রাণ কেন্দ্রে পরিণত হয় প্রেসটি। যার কেন্দ্রে ছিলেন প্রেসটির মালিক গোলাম রব্বানী বানী ভাই। মূলত তার অনুপ্রেরণাতেই পঞ্চগড়ের ঝিমিয়ে পড়া সাহিত্য সংগঠনগুলো আবারো নতুন উদ্যোমে কাজ করতে শুরু করে। কয়েকটি সাহিত্য সংগঠনের নিজস্ব কোন অফিস না থাকায় খাতা কলমে সিটি প্রেসকেই অফিস হিসেবেই উল্লেখ করতো। কখনো কখনো কাজের ব্যাঘাত ঘটলেও বানী ভাই নিরবে হজম করতেন কবি সাহিত্যিকদের এই অত্যাচার।
তিনি নিজেও সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মীদের সাথে মেতে উঠতেন আড্ডায়। চায়ের কাপে কাপে জমতো কত সব গল্প। এই প্রেস থেকেই পঞ্চগড় সাহিত্য সংসদের সভাপতি আরিফুল ইসলাম পল্লব ভাইয়ের মাসিক ‘কথা’ পত্রিকা বের হতো নিয়মিত। এছাড়া বহুভূজ সাহিত্য পরিষদের খড়কুটো, হিমালয় কনিষ্ঠাসহ বিভিন্ন সাহিত্য পরিষদের স্মারক গ্রন্থ ও লিটলম্যাগ বের হতো। পঞ্চগড় মকবুলার রহমান সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের ছাত্র হিসেবে লেখালেখির প্রতি আমার দুর্বলতা ছিলো। আমার সম্পাদনায় বিভাগের প্রথম লিটলম্যাগ রক্তে কেনা বর্ণমালা প্রকাশ করলাম বানী ভাইয়ের সিটি প্রেস থেকেই। পরে বিভাগীয় লেখক পরিষদের উদ্যোগে ‘আরশি’ ও ‘কালের আরশি’ দুটি ম্যাগাজিন আমার সম্পাদনায় বের হয় এই প্রেস থেকেই। ছোট ভাই সৌরভের বেরং সহ কয়েকটি লিটল ম্যাগ প্রকাশ হয় এই প্রেস থেকে। লিটলম্যাগ বের করার উদ্যোগ নিলেই বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিতেন বানী ভাই। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে গভীর রাত কখনো ভোর পর্যন্ত কাজ চলতো সিটি প্রেসে। কখনো বিরক্ত হতে দেখিনি এই বড় মনের মানুষটিকে। বরং কোন ম্যাগাজিন প্রকাশের দিনক্ষণ ঠিক হলে ওই দিনের আগেই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি জনবল নিয়োগ করে বইয়ের সেটাপ তৈরি, ট্রেসিং করা, প্রিন্ট করা এবং বাঁধাই করে তা আমাদের হাতে তুলে দিতেন। তিনি আমাদের কাছে কেবল কাগজসহ খরচের দাম নিতেন। কোন মুনাফা করতেন না। এভাবেই কদম তলা আর নিউ সিটি অপসেট প্রেস হয়ে উঠে কবি সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের আড্ডার স্থান হিসেবে। অনেক সময় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতাও করেছেন। নাট্য সংগঠন ভূমিজেও উপদেষ্টা হিসেবে সহযোগিতা করেছেন আন্তরিকভাবে। সবশেষ জলবাংলার কবি আবুল কালাম আজাদের পঞ্চগড়ের ইতিহাস নিয়ে দুটি বই বিনামূল্যে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেন বানী ভাই। সব সময় পর্দার পেছনে থেকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি কবিদের সাহস জুগিয়েছেন তিনি। করেছেন সহযোগিতাও। আমার বড় ভাই কবি ও সাহিত্যিক ছায়েদ আলীর সাথে তার সখ্যতা ছিলো গভীর। সেই সুবাধে আমাকে ছোট ভাই হিসেবে স্নেহ করতেন। বয়সে অনেক বড় হলেও আমাদের সাথে মিশতেন বন্ধুর মতো। সাংবাদিক পেশায় সময় দেয়ার কারণে সাহিত্য কর্মে আমার একটু ভাটা পড়ে। তাই বানী ভাইয়ের প্রেসে আগের মতো যাওয়া হয়ে উঠতো না। গত এক মাস আগের কথা একটি কাজের জন্য গিয়েছিলাম সিটি প্রেসে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হলো ভাইয়ের সাথে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘লুৎফর আগের মতো এখন আর ম্যাগাজিন বের হয় না’। সব কেমন জানি বদলে যাচ্ছে। সাহিত্য চর্চার জন্য তিনি আমাকে পঞ্চগড়ের জন্য একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নিতে বললেন। আমাকে অভয় দিয়ে বললেন প্রেসের সব খরচ তিনিই বহন করবেন। কোন আকৃতির কোন ধাচের পত্রিকা হবে তাও আলোচনা হলো। তারপর নানা ব্যস্ততায় এই দু মাসে আর তেমন কোন কথা হয় নি ভাইয়ের সাথে। আজ সকালে ঘুম ভাঙে তার মৃত্যুর সংবাদে। ঘুম ঘুম চোখে অনেকক্ষণ বসে থাকলাম। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এভাবে স্বপ্নচারী মানুষটি চলে যাবে কখনো ভাবি নি। বানী ভাইয়ের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এখনো তাকে মৃত ভাবতে পারছি না। আর হয়তো বানী ভাইয়ের সাথে আড্ডা দেয়া হবে না কদম তলার প্রেসে। আর হয়তো কেউ ডেকে বলবে না ‘কৈ ম্যাগাজিন বের করবি না’। ওপারে স্রষ্টা বানী ভাইকে ভাল রাখুন।
You cannot copy content of this page