সব প্রস্তুতি শেষ। এখন শুধুই অপেক্ষার পালা। সর্বোত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে চালু হতে যাচ্ছে অনলাইন চা নিলাম কেন্দ্র। বর্তমানে চট্টগ্রাম এবং শ্রীমঙ্গলে দুইটি চা নিলাম কেন্দ্র চাল রয়েছে। আগামী ২ সেপ্টেম্বর শনিবার দেশের তৃতীয় এই চা নিলাম কেন্দ্র উদ্বোধন করবেন বানিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। জেলায় চা নিলাম কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হলে তৈরিকৃত চা পরিবহন খরচ কমে যাবে। পাশাপাশি ব্যাপকভাবে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। নিলাম কেন্দ্রে চায়ের উম্মুক্ত কেনাবেচায় ক্ষুদ্র চা চাষীরা চায়ের কাঁচাপাতার ন্যায্যমুল্য পাবেন। এতে গোটা উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির আমুল পরিবর্তন হবে বলে সংশ্লিষ্টদের আশা।
রোববার সরেজমিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, জেলার চা শিল্পের সাথে জড়িতদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ আর উদ্দীপনা কাজ করছে। অনলাইন এই চা নিলাম কেন্দ্র চালু করতে ইতিমধ্যে ওয়ার হাউস, ব্রোকার হাউজ নির্মাণসহ বায়ারদের অনুমোদন দেওয়া হযেছে। অনলাইন এ্যাপস তৈরিসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। এখন শুধুই নিলাম কেন্দ্র উদ্বোধনের অপেক্ষা।
পঞ্চগড় আঞ্চলিক চা বোর্ড সূত্র জানায়, পঞ্চগড়ে ২০০০ সাল থেকে চা চাষের শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকার নদী সংলগ্ন এবং পতিত জমিতে দিনদিন বৃদ্ধি পেতে থাকে চা চাষের পরিধি। এক পর্যায়ে গোটা এলাকা চায়ের সবুজে ভরে উঠে। জেলায় এ পর্যন্ত ১০ হাজার ২৪০ একর জমিতে চা আবাদ সম্প্রসারিত হয়েছে। ৮ টি নিবন্ধিত ও ২০ টি অনিবন্ধিত চা বাগান, সাত হাজার ৩৩৮ টি ক্ষুদ্রায়তন এবং এক হাজার ৩৬৮ টি ক্ষুদ্র চা বাগান গড়ে উঠেছে। পঞ্চগড়কে অনুসরণ করে চা চাষে এগিয়ে যাচ্ছে পাশের জেলা ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট। ইতিমধ্যে ঠাকুরগাঁওয়ে এক হাজার ৪৫৭ দশমিক ২৯ একর, লালমনিরহাটে ২২২ দশমিক ৩৮ একর, দিনাজপুরে ৮৯ একর এবং নীলফামারীতে ৭০ দশমিক ৫৯ একর জমিতে চা আবাদ সম্প্রসারণ হয়েছে। সর্বশেষ উত্তরাঞ্চল চা চাষ প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড়সহ পাঁচ জেলায় মোট ১২ হাজার ৭৯ দশমিক ৬ একর জমিতে ৩০টি চা বাগান এবং ৮ হাজারের বেশি ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান গড়ে উঠেছে।
চা উৎপাদনের হিসেবে চট্টগ্রামকে ছাড়িয়ে এই চা অঞ্চল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ২০২১ সালে এই চা অঞ্চলে চা আবাদে জমির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৪৩৩ দশমিক ৯৪ একর। উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা। গত ২০২২ মৌসুমে এক কোটি ৭৭ লাখ ৮১ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। যা বিগত বছরের তুলনায় ৩২ লাখ ১৯ হাজার ২২৬ কেজি বেশি এবং দেশের মোট উৎপাদনের ১৯ শতাংশ। বৈশ্বিক মহামারি উপেক্ষা করে জেলার ২৫টি চা কারখানায় উৎপাদিত চা নিলাম কেন্দ্রের মাধ্যমে ২৬০ কোটি টাকা মুল্যের চা বিক্রি করা হয়েছে। চা বাগান আর চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় জেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হয়েছে।
তবে কয়েক বছর ধরে চায়ের কাঁচা পাতার ন্যায্যমুল্য না পেয়ে লোকসান গুনতে হয় ক্ষুদ্র চা চাষীদের। হতাশা দেখা দেয় চা চাষীদের মধ্যে। কাঁচা চা পাতার মুল্য নির্ধারণ কমিটির ১৮ টাকা কেজি দরে মুল্যেও কারখানায় বিক্রি করতে পারেন না চা চাষীরা। বাধ্য হয়ে তারা ১২ থেকে ১৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। এর বাইরে নানান অজুহাতে কাঁচা পাতার ওজন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর্তন করে মুল্য পরিশোধ করেন কারখানা মালিকরা। তবে এখানে দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র চালু হলে চা চাষীরা কাঁচা পাতার ন্যায্যমুল্য পাবেন বলে আশা তাদের।
পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের ক্ষুদ্র চা চাষী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা ৪/৫ বছর ধরে চা আবাদে ক্ষতির সমুক্ষীণ হচ্ছি। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে পাতা বিক্রি করতে হয়। ১৮ টাকা কেজি দরে পাতা কিনার কথা থাকলেও বাধ্য হয়ে ১২ থেকে ১৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হয়। আবার পাতার ওজন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর্তন করেন কারখানা মালিকরা। এখানে চা নিলাম কেন্দ্রটি চালু হলে আশা করি আমরা উপযুক্ত দাম পাবো। আমরা চাই দ্রæত এই নিলাম কেন্দ্র চালু করা হোক।
উপজেলা সদরের সাজেদা-রফিক চা কারখানার পরিচালক মো. আরিফজ্জামান সুমন বলেন, এখানে চা নিলাম কেন্দ্র চালু হলে আমাদের পরিবহন খরচ অনেক কমে যাবে। বর্তমানে আমাদের কারখানায় উৎপাদিত চা বিক্রির জন্য চট্টগ্রাম আর সিলেটের শ্রিমঙ্গলের চা নিলাম কেন্দ্রে পাঠাতে হয়। এজন্য অতিরিক্ত পরিবহন খরচ লাগে। আমাদের উৎপাদন ও পরিবহন খরচ কমলে চা চাষীরা আরও বেশি দাম পাবে। তবে চা চাষীরা ভালো মানের কাঁচা পাতা সরবরাহ করতে পারলে আমরাও ভাল মানের চা উৎপাদন করতে পারবো। এতে চা চাষীরাও কাঁচা চা পাতার ভালো দাম পাবেন।
পঞ্চগড় আঞ্চলিক চা বোর্ডের উন্নয়ন কর্মকত কৃষিবিদ আমির হোসেন বলেন, পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চল চা চাষ প্রকল্পের আওতায় প্রতিনিয়ত চা চাষের পরিধি বাড়ছে। এখানে উৎপাদিত চা চট্টগ্রাম অথবা শ্রীমঙ্গলের চা নিলাম কেন্দ্রে কেনাবেচা হয়। গত বছরের ২৩ অক্টোবর পঞ্চগড়ে দেশের তুতীয় চা নিলাম কেন্দ্রের অনুমোদন দেয় সরকার। এরপর কাজ শুরু করে বাংলাদেশ চা বোর্ড। দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র চালু করতে ওয়ার হাউস, ব্রোকার হাউজ অনুমোদন দেওয়া হযেছে। ইতিমধ্যে অনলাইন এ্যাপস তৈরিসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়।
জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দুই সেপ্টেম্বর পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় নিলাম কেন্দ্র্রটি উদ্বোধন করা হবে। বানিজ্য মন্ত্রনালয়ের নির্দেশনামতে মাননীয় বানিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি, মাননীয় রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাসম সুজন এর উদ্বোধন করবেন। ইতিমধ্যে এখানে একাধিক ব্রোকার হাউজ, ওয়ার হাউস নির্মান করা হয়েছে। নিদের্শনামত আমরা সকল প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছি। এখানে অনলাইন বেইজ নিলাম কেন্দ্রটি চালুর পর চা চাষী থেকে শুরু করে চা শিল্পের সাথে জড়িত সকলেই সম্পৃক্ত থাকবেন। বিশেষ করে চা চাষীরা নিজেরাই দেখতে পাবেন চা এর মুল্য এখন কোথায় কি রকম চলছে। নিলাম কেন্দ্রে চায়ের মুল্য যখন সকলের কাছে উন্মুক্ত হবে, তখন চা চাষীদের ন্যায্যমুলের বাইরে কাঁচা পাতা কেনার আর সুযোগ থাকবে না। নিলাম কেন্দ্রটি চালুর ফলে গোটা উত্তরের অর্থনীতির আমুল পরিবর্তন আসবে বলে আমরা মনে করি।।
You cannot copy content of this page