বিশেষ প্রতিনিধি
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) রাস্তা করে দিলেও একটি সেতুর অভাবে জন দূর্ভোগের সীমার কোন নেই পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার মানুষের। ইট দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে তৈরী হওয়া সেতুটির নিচের অংশে ২০১৭ সালের ১৫ই আগষ্টে বন্যার পানির প্রবল স্রোতে সেতুর নিচে মাটি সরে যাওয়ায় সেতুটির বিভিন্ন অংশে ফাঁটল দেখা দিয়েছে। বর্তমানে মানুষ ও যান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে সেতুটি। বর্ষা মৌসুম আসায় ওই রাস্তায় চলাচল করা আরো কষ্টসাধ্যে হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সেতুটির দক্ষিণ অংশে ভেঙ্গে যাওয়া অংশে বাশঁ আর কাঠ দিয়ে সাকোঁ তৈরী করেছে স্থানীয়রা। ওই সাকোঁর উপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে ভ্যান-রিক্সা, মোটরসাইকেল চলাচল করলেও শুকনো মৌসুমে সেতুর পাশ দিয়ে বিকল্প পথ তৈরী করে ভারি যান চলাচল করেছে। বর্ষাকাল চলে আসায় সেতুর উপর দিয়ে ভ্যান-রিক্সা চলা তো দূরের কথা সাইকেল মোটরসাইকেল নিয়ে পথচারীদের ওই ইউনিয়নের পুঠিমারী-উলিপুকুরী হয়ে ৬ থেকে ৭ কিলোমিটার রাস্তা ঘুরে বিকল্প পথে চলাচল করতে হয় পথচারীদের। ভাঙা সেতুর উপর দিয়ে চলাচলে যে কোন সময় বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। পথচারীদের অভিযোগ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উপজেলা প্রকৌশলী কিংবা উপজেলা প্রশাসনের কোন কর্মকর্তাকে সেতুর ভাঙা অংশে দেয়া সাকোর মেরামত কিংবা নতুন সেতু তৈরী নিয়ে কোন পদক্ষেপই গ্রহন করেননি।
পঞ্চগড় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্রে জানা যায়, বোদা উপজেলার বেংহারী বনগ্রাম ইউনিয়নের তেপুকুরিয়া-পুঠিমারী মিশন সড়কের উপরে ১৯৮৮ সালে এই ১২ মিটার লম্বা এবং ৩ মিটার প্রশস্ত সেতুটি তৈরী করা হয়। সেতুটি ইট দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে তৈরী করে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়। ওপেন ফাউন্ডেশন সেতু (ওএফসি) হিসেবে নির্মাণ করা হয়। সেতুটি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বেংহাড়ি বনগ্রাম ইউনিয়নের পুঠিমারি মিশন রাস্তার দক্ষিণ তেপুকুরিয়া নামক এলাকায় অবস্থিত। গত ২০১৫-১৬ সালে বোদা উপজেলার সাকোয়া-আলিম বাজার হয়ে পুঠিমারি এবং পুঠিমারি হয়ে উপজেলার ময়দানদিঘী বাজার পর্যন্ত প্রায় ১১ কিলোমিটার পাঁকা সড়ক নির্মাণ হয়। জিওবি’র অর্থায়নে রাস্তাটি নির্মিত হয়। ফলে ওই এলাকার মানুষের জীবন-যাত্রার মান বৃদ্ধি পায়। অথচ অপরিকল্পিত ওপেন ফাউন্ডেশনে নির্মিত সেতুটির ভগ্ন দশায় ‘সেই জীবনযাত্রার মান বিঘ্ন সৃষ্টি করে রেখেছে। স্থানীয় জন সাধারনের মতে সেতুটি বহু পুরনো। নতুন সেতু নির্মাণ না করা হলে মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকবেনা।
জানা যায়, এই সেতুর উপর দিয়ে দেবীগঞ্জ উপজেলার চিলাহাটি, বোদা উপজেলার বড়শশী, কাজলদিঘী কালিয়াগঞ্জ, বেংহারী বনগ্রাম, মাড়েয়া বামনহাট এবং ময়দানদিঘী ইউনিয়নের বগদুলঝুলা, বড়শশী, ভাউলাগঞ্জ, উলিপুকুরী, পুঠিমারী, চছপাড়া, বেংহারী, ধনিপাড়া, প্রধান পাড়া, তেপুকুরিয়া মিশন এলাকার ৫০ হাজারের মত লোক ওই রাস্তা দিয়ে নিয়মিত চলাচল করে। এই রাস্তাটি বোদা উপজেলার উলিপুকুরী হয়ে করতোয়া নদীর বাগডোগরা ঘাটে গিয়ে ঠেকেছে। এছাড়া অপরদিকে পুঠিঁমারি হয়ে ময়দানদীঘি বাজারে গিয়ে ঠেকেছে। ওই ৬ ইউনিয়নের মানুষজনের সরকারী কিংবা ব্যাক্তিগত যে কোন ধরনের কাজে বোদা উপজেলা শহরে যেতে একমাত্র পথ এটি। এসব এলাকার ফসলি জমিতে ধান,গম, আলু, মরিচ,পেয়াঁজ সহ সব ধরনের ফসল উৎপাদন হয়। কৃষি এলাকা হিসেবে পরিচিত পাওয়া এসব মানুষের কৃষি সহ জরুরী যে কোন পন্য পরিবহনে ভোগান্তির কোন শেষ নেই। সেতুটির জন্য বড় অসহায় হয়ে পড়েছে পথচারীরা। সেতুটির নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নয়নজলিটি বর্ষায় চাপ পড়ে ধসে যায়। এসব এলাকার ফসলি জমির একটি পানির বড় অংশ এই সেতুটির নীচ দিয়ে বয়ে যায়। অপরিকল্পিত ভাবে সেতুটি নির্মাণ করায় দক্ষিণ অংশের মাটি সরে গিয়ে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এখন কাঠ আর বাঁেশর নরবড়ে খটখটি দিয়ে মানুষ পারাপার হচ্ছে। এর মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে গিয়ে অনেক পথচারী তাদের যানবাহন, পন্য নিয়ে পানিতে গেছে। ২০১৮ সালে এক পথচারী সেতুর নীচে পানিতে পড়ে গুরুতর আহত হন। পরে তাকে উদ্ধার করে বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে স্থানীয়রা। পরে ওই ব্যাক্তির শারিরিক অবস্থার অবনতি হলে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন।
কাজলদিঘী কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নের গোলাম মোস্তফা নামে এক স্বাস্থ্য সহকারী বলেন, আমি একজন ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সহকারী হওয়াতে সপ্তাহে প্রায় ৫ দিন বোদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন কাজে যেতে হয়। স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে আসতে হয়। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই আমাকে বাধ্য হয়ে ঝুঁকি এই সেতুর উপর দিয়ে চলাচল করতে হয়। যদি এই সেতুটি দ্রুত নির্মান করা হয় তবে আমার মত অনেকেরই কষ্ট লাঘব হবে।
সাইফুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক বেকারীর ভ্যান চালক জানান, প্রতিদিন আমাকে ভ্যানে করে বাড়তি কিছু কাঠ নিয়ে আসতে হয় সাকোঁর ভাঙা অংশে দেয়ার জন্য। দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সাধারণ কোন পথচারীর সাহয্যের জন্য। তা না হলে ভাঙা সেতুর উপর দিয়ে বেকারীর পন্য নিয়ে চলাচল করতে গিয়ে দূর্ঘটনার শিকার হলে রোজগারের একমাত্র অবলম্বন ভ্যান গাড়িটিই শুধু ক্ষতিগ্রস্থ হবে না বেকারীর পন্যর জরিমানা দিতে হবে। বন্ধ হয়ে যেতে পারে আমার উপার্জন। মহাজন তো এ ক্ষতির কোন দায় নিবে না।
মো. সাহেব আলী নামে স্থানীয় এক সমাজসেবক জানান, সেতুটির একপাশে বার বার ভেঙ্গে যাওয়ায় আমি চারবার নিজ উদ্যোগে প্রায় ৪২ হাজার টাকা ব্যয় করে স্থানীয়দের সেচ্ছাশ্রমে সাকোঁ নির্মাণ করি। কোন মতে মানুষ চলাচলের জন্য উপযোগী করে রেখেছি। কিন্তু এভাবে তো চলতে পারেনা। এ ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের স্থায়ী একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। তা নাহলে সাধারণ মানুষের এ ভোগান্তি লাঘব হবে না। আমি আর কত করবো। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তো কিছু করতে হবে। তারা এগিয়ে আসছেনা। এভাবে আর কত দিন।
বেংহারী বনগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ আবু জানান, তেপুকুরিয়া মিশন সেতুটি ১৯৮৮ সালে তৈরী। এ পথে ৬ টি ইউনিয়নের ৫০ হাজারের মত মানুষের চলাচল। সেতুটি নির্মাণের জন্য আমি উপজেলা ত্রাণ শাখায় এবং এলজিইডিতে যোগাযোগ করি। পরে সেতু নির্মাণে ত্রাণ শাখা এগিয়ে এলেও এলজিইডি এগিয়ে আসেনি। ইতিমধ্যে ত্রাণ শাখার প্রকৌশলী এসে মাটি পরীক্ষার জন্য নমুনা নিয়ে গেছে। তারা আমাকে জানিয়েছে খুব শীঘ্রই সেতুটির কাজ শুরু হবে।
বোদা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো আব্দুল মোমিন জানান, ওই এলাকায় আমি গিয়েছিলাম। মাটির নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে ৫০ ফিট লম্বা একটি ঢালাই করা সেতুর জন্য আবেদনের কাগজপত্র পাঠিয়েছি। বরাদ্দ হলে টেন্ডারের মাধ্যেমে সেতুটি খুব দ্রুতই তৈরীর কাজ শুরু হবে।
এ বিষয়ে পঞ্চগড়ের এলজিউডি নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুজ্জামান বলেন, যদিও সেতুটি আমাদের নয়। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় হতে ১৯৮৮ সালে ওপেন ফাউন্ডেশন করে ব্রীজটি নির্মাণ করা হয়। আমি ওই জায়গাটিতে দু’বার পরিদর্শন করেছি’। সেতুটির দুই পাশের এ্যাপ্রোচ সড়ক ভেঙ্গে গেছে। সেতুটির অবস্থাও নাজেহাল। মেরামত করে কোন কাজ হবেনা। যেহেতু ওই এলাকায় আমাদের পাঁকা সড়ক রয়েছে। তাই আমরা সেতু নির্মাণে এগিয়ে এলেও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় হতে জানা যায় সেতুটি তারা নির্মাণ করবে। এ কারণে আমরা আপাতত চুপ রয়েছি। তবে তারা যতি সেতুটি নির্মাণ না করে তাহলে তো আমাদেরই করতে হবে। কেননা মানুষের চলাচলে অনকে ভোগান্তি হচ্ছে বলে আমরা জেনেছি।
You cannot copy content of this page